পরিশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশ্ন করিয়াছেন : ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।’ আর নৈবেদ্যে তিনি স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, ‘ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,/ হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা/ তোমার আদেশে।’ ইহার পর তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহার মর্মার্থ হইল—অন্যায়কারী ও অন্যায় সহ্যকারী উভয়েই সমান অপরাধী। অর্থাৎ অন্যায় সহ্য করা হয় বলিয়াই অন্যায়কারী অন্যায় করিয়া যাইতে পারে। তবে আরো বাস্তবতা হইল, অন্যায় সহ্যকারীদের সহনশীলতার সুযোগ লইয়া অন্যায়কারীরা যদি দিনের পর দিন অন্যায় কাজ করিয়া যাইতে থাকে, তাহা হইলে সেই সমাজে বা রাষ্ট্রে একটি ভারসাম্যহীনতা তৈরি হইবে। এই বিশ্বজগৎ এক অপূর্ব ভারসাম্যপূর্ণ লীলাক্ষেত্র। ভারসাম্যকে আমরা ‘সীমা লঙ্ঘন না করিবার’ সহিত তুলনা করিতে পারি। অর্থাৎ ভারসাম্য ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ সীমা লঙ্ঘন করা না হয়।
দুঃখজনকভাবে আমরা চারিদিকে সীমা লঙ্ঘনের বাড়াবাড়ি দেখিতে পাইতেছি। পৃথিবীর এক দম বন্ধ করা অবস্থা বিরাজ করিতেছে। ইউক্রেনের জন্য এই সময়ের যুদ্ধটি অনেকের দৃষ্টিতে একটি ট্র্যাজেডি বটে। কারণ, প্রায় তিন দশক পূর্বে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন হইতে সদ্যস্বাধীনতা পাওয়া দেশ ইউক্রেন ছিল বিশ্বের ‘তৃতীয় বৃহত্তম’ পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। ইউক্রেনকে অতিদ্রুত পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করিতে উদ্যোগ লইয়াছিল বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রত্রয় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। ইউক্রেনের নিরাপত্তা এই দেশত্রয় দেখিবে—এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে ১৯৯৪ সালে বুদাপেস্ট স্মারক নামে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি সই করে ইউক্রেন; কিন্তু এখন যেন ইউক্রেনকে লইয়া বহুমেরু বিশ্বে নিত্যনূতন খেলা চলিতেছে। ইহা বুঝিতে কাহারো রকেট সায়েন্টিস্ট হইতে লাগে না যে, স্বাধীনতার পর সোভিয়েত আমলে পাওয়া হাজারো পারমাণবিক অস্ত্রের ছিটেফোঁটাও যদি ইউক্রেনের হাতে থাকিয়া যাইত, তাহা হইলে ইউক্রেনের এখন এই দশা হইত না। অন্যদিকে বর্তমান যুদ্ধকালে যাহারা পরমাণু অস্ত্রের ভয় দেখাইতেছে, তাহারাও এই সত্য জানেন যে, ইউক্রেনের পক্ষাবলম্বনকারী শক্তিরও বিপুল পরিমাণে এই অস্ত্র রহিয়াছে। আসলে নিজে কাচের ঘরে থাকিয়া অন্যের কাচের ঘরের দিকে ঢিল ছুড়িবার হুমকির কোনো অর্থ হয় না।
উন্নয়নশীল বিশ্বের সমস্যাও কম গুরুতর নহে। এই বিশ্বের কিছু কিছু জনপদে ক্ষমতা কুক্ষিগত করিবার হীনচেষ্টা বরাবর দেখিয়া আসিতেছে বিশ্ববাসী। তবে ইতিহাসের পাতাতেই দেখা যায়, যাহারা সকল কিছু কুক্ষিগত করিতে চাহেন, তাহারা শেষাবধি পরিহাসে পরিণত হন। উন্নয়নশীল বিশ্বে যাহারা ক্ষমতায় থাকেন, তাহারা যেন মনে করেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ আর কাহারো নহে—তাহাদের এবং তাহাদের দলের নেতাকর্মীদের। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার কোথাও কোথাও দেখা গিয়াছে যে, এককভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কয়েক দশক ধরিয়া যাহারা ক্ষমতায় থাকিয়া সাময়িকভাবে লাভবানও হইয়াছিলেন, পতনের পর তাহাদের পরিণতি হইয়াছিল তাসের ঘরের মতো। সুতরাং সকল কিছু কুক্ষিগত করিবার সুদূরপ্রসারী এই প্রতিক্রিয়া উপেক্ষণীয় নহে। অর্থাৎ এইভাবে তো চলিতে পারে না। সকলেই তো রাজা হইতে চাহে না। বরং সাধারণ নাগরিক চাহে কাজ করিতে এবং কাজের বিনিময়ে অর্থ-সম্মানি। মনে রাখিতে হইবে, গোঁজামিল দিয়া বেশি দিন টিকিয়া থাকা যায় না। গোঁজামিলের পরিবর্তে কোনো পদক্ষেপ যৌক্তিকভাবে গ্রহণ করা হইলে যত বাধাবিপত্তিই আসুক না কেন—তাহা টিকিয়া যাইবে।
প্রকৃতপক্ষে যাহারা যথার্থ জ্ঞানী, তাহারা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি করিতে ভয় পান। অন্যদিকে যাহারা অপরিণামদর্শী, তাহারাই কেবল সীমা লঙ্ঘনের বিপদ অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হন। ইহা সকল ক্ষমতাধারীকে বুঝিতে হইবে। সক্রেটিস বলিয়াছেন—“অতএব সেই ব্যক্তি জ্ঞানী, যিনি তাহার অজ্ঞতার ‘রকম ও পরিমাণ’ জানেন।” সুতরাং নিজের ‘অজ্ঞতা’কে সকলের পূর্বে জানিতে হইবে; কিন্তু যাহারা ‘নিজেকে’ জানেন না, তাহারা নিজের অজ্ঞতাও জানেন না। বিপদ এইখানেই। নিজেকে সর্বাগ্রে জানিতে হইবে—কান পাতিয়া শুনিতে হইবে—ঘণ্টাধ্বনি বাজিতেছে কি না। ঘণ্টা তো বাজিবেই—উহাই জগতের নিয়ম; কিন্তু ঘণ্টাধ্বনি উপেক্ষা করা ঠিক নহে। উহা বুদ্ধিমানের কাজ নহে।
আপনার মতামত লিখুন :